বাংলাদেশ, , বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

মহামায়ার আরাধনার মধ্যেই পরমাত্মার মিলন : পণ্ডিত তরুণ কুমার আচার্য

  প্রকাশ : ২০১৯-১০-০১ ১৮:২৯:৩২  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : সুপ্রাচীন কাল থেকে বেদের দার্শনিক সিদ্ধান্তগুলি তন্ত্রের পূজাদি অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একে অন্যের অভাব পূরণ করেছে। কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে যজ্ঞ ও পূজা উভয় অপরিহার্য। যজ্ঞ বেদের দান আর পূজা তন্ত্রের। এ দুয়ের মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও পরিণামে দুটো পরস্পরের পরিপূরক হয়ে মানবের জীবনধারায় ও সমাজের বিভিন্ন কর্মেেত্র এক অপূর্ব সামঞ্জস্য বিধান করেছে।
বেদ ও তন্ত্রের এবং দর্শন ও বিজ্ঞানের মিলন সমগ্র মানবসমাজের জীবনে এক মহাগৌরবের বিষয়। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার পূর্বে সমগ্র পৃথিবীতে মানবসমান তন্ত্র সাধনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতিতে প্রশান্তি বোধ করেছিল। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার মুখে সে আত্মিক প্রশান্তি আজ ম্রিয়মাণ। কিন্তু ঋষিগণ বেদ ও তন্দ্রের দর্শন ও বিজ্ঞানের অপূর্ব মিলন ঘটিয়ে সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে অমৃতের সন্ধান দিয়েছে তার জন্য আমরা সত্যি সত্যিই উপকৃত।
তাই অন্যান্য ধর্মাপক্ষা সনাতন ধর্মে তথা হিন্দুধর্মে শক্তিবাদ সমৃদ্ধি লাভ করেছে। যা চণ্ডীতে পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রাচীন যুগে সমগ্র পৃথিবী তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। যেমন: (১) বিষ্ণুক্রান্তা, (২) রথক্রান্তা ও (৩) অশ্বক্রান্তা এবং তিনটি অঞ্চলে বিভাজনের জন্য ভারতবর্ষের বিদ্ধ্যাপর্বতকে কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই তিনটির প্রত্যেক অঞ্চলে ৬৪টি থানা তন্ত্রগ্রন্থ প্রচলিত ছিল। তাই সমগ্র ভারতবর্ষে তার সংলগ্ন এলাকায় সর্বমোট ১৯২টি তন্ত্রশাস্ত্র প্রচলিত ছিল। সব তন্ত্রশাস্ত্রসমূহের সমন্বিত সারবস্তুই বর্তমান শ্রীশ্রী চণ্ডীগ্রন্থের মার্কণ্ডেয় পুরাণের একটি অংশ, যাকে দেবীমাহাত্ম্যও বলা হয়।
* সকল ধর্ম শাস্ত্রেরই প্রধান লক্ষ্য পরমাত্মার জ্ঞান এবং পরমাত্মার সাথে আত্মার মিলন। আসলে আমি যে সবসময় আমি, আমি করি সেই আমিটা কে? বাস্তবিকই এটা জানার প্রয়োজনেই নিজ আত্মাকে জানার জ্ঞানই আত্মজ্ঞান। আমাদের আপন স্বরূপকে জানার জন্য আমরা খুবই উদগ্রীব। যতণ পর্যন্ত নিজেকে বুঝা বা জানা না যায় ততক্ষণ সে একটা সাধারণ জীব।
যখন জীব এ আত্মা সম্পর্কে জানতে পারে তখন তাকে ভক্ত, সাধক ইত্যাদি হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। দেবীসূক্তে “অহং”রূপে যে তত্ত্ব প্রকাশিত শ্রীশ্রী চণ্ডীতে এটিই মহামায়ারূপে আবির্ভূত। তাই দেবীসূক্ত না জেনে শ্রীশ্রী চণ্ডীতত্ত্বে প্রবেশ শাস্ত্রনিষিদ্ধ। দেবী মাহাত্ম্যে পরমাত্মাই মহামায়ারূপে উপখ্যানাকারে বর্ণিত। পরমাত্মা ও মহামায়া অভিন্ন। কিন্তু যারা রাজযোগে অভিজ্ঞ তারাই জানেন আত্মা ও মায়া সম্পূর্ণ অভিন্ন।
পূজার সাথে আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও ধ্যান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই পূজার সুবিন্যস্ত পদ্ধতিতে এ সমস্ত বিষয়ের ব্যবস্থা আছে। যেমন :পূজার বিন্যাসে আচমন, স্বস্তিবাচন, সংকল্প, ঘটস্থাপন, প্রাণপ্রতিষ্ঠা, দ্বারদেবতা, পূজা, শুদ্ধি, পঞ্চশুদ্ধি, বিঘ্নপসারণ, আসনশুদ্ধি, করশুদ্ধি, দিব্যবিঘ্ননিবারণ, বিদ্বঞ্জন, প্রাণায়াম, হোম, বিসর্জ্জন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দেহমন শুদ্ধ না থাকলে আধ্যাত্মিক সাধনের যোগ্যতা হয় না। তাই আচমনের মুখ্য উদ্দেশ্য দেহমান শুদ্ধ করে অভিষ্ট কর্মের সফলতা সর্বভূতের কল্যাণ প্রার্থনায় স্বস্তিবাচনের মূলকথা।
যে উদ্দেশ্যে পূজা, সাধকের মনে দৃঢ়মূল করে দেওয়ার জন্য সংকল্প, ঘটস্থাপন পূজার একটি বিশেষ অঙ্গ। ঘটস্থাপনের মাধ্যমে দেবতাকে আহ্বানপূর্বক পূর্জার্চ্চনা করা হয়। ঘট হৃদয়, গুহার অনুকল্প, হৃদয়েই আত্মার কেল্লা, ঘট সেই হৃদয়েরই প্রতীক। প্রতিমা পূজার প্রাণপ্রতিষ্ঠা একটি অবশ্য করণীয় অনুষ্ঠান। সাধকের নিজের আত্মসত্ত্বাকে সমুখস্থ প্রতিমায় আরোপিত করাই প্রাণপ্রতিষ্ঠার মূলকথা। নিজের দিব্যত্ব কল্পনা করে আত্মার চেতনা জাগ্রত করা, মহামায়া বা পরমাত্মার মিলনে প্রত্যেক সাধকই তার ভিতরে অন্তর্নিহিত বিকারশত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে। তাই এ বিজয় হয় আধ্যাত্মিক বিজয়। তাই আমরা যেন বিজয়ার পুনর্মিলনী দিয়ে প্রত্যেকেই কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও অহংকার থেকে মুক্তি লাভ করে আমাদের বিচারাঙ্গনকে উন্নতি ও সুবিচারের ভিত্তি শক্ত করার লক্ষ্যে অকৃত্রিম সাধনায় লিপ্ত সকলের উচিত বলে মনে করি। তাই এই দিনে মহামায়ার প্রাপ্তির লক্ষে দিব্যগুণ অর্জনের মাধ্যমে অসৎকে সৎপথে তামসিকে সাত্ত্বিকে, অন্ধকারকে জ্যোতিতে রূপান্তরিত করার চিন্তাচেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

লেখক:
পণ্ডিত তরুণ কুমার আচার্য (কৃষ্ণ)
জ্যোতিষ ভাষ্কর, গোল্ড মেডেলিষ্ট কলকাতা, ভারত
চেয়ারম্যান, পণ্ডিত নিরোদলীলা গীতা বিদ্যাপীঠ



ফেইসবুকে আমরা