বাংলাদেশ, , শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

ভূবনজয়ী হাসির জন্য চাই সুস্থ দাঁত : ডা. মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০২০-০৩-০৫ ২০:২৯:০৫  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : বলা হয়, সুন্দর হাসি দিয়ে বিশ্ব জয় করা যায়। আসলেই তাই। তবে সুন্দর হাসির জন্য চাই সুস্থ ও উজ্জ্বল চকচকে দাঁত। তা না হলে হাসি দেয়াই যে কষ্টকর হয়ে ওঠে। সাধারণত, সঠিক যত্নের অভাব ও কিছু অভ্যাসের কারণে দাঁতের সৌন্দর্য নষ্ট হয়। দাঁতের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর ৬ মার্চ ‘ডেন্টিস্ট ডে’ পালিত হয়ে থাকে। আজ বিশ্ব ডেনিস্ট দিবস। অত্যান্ত জাঁকজমকভাবে সারাবিশ্বের সাথে বাংলাদেশেও পালিত হবে দিবসটি। আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বের দন্ত চিকিৎসা সেবায় জড়িত মহান সব দন্ত চিকিৎসকদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। দাঁত যে কত প্রয়োজনীয় সেটা আমরা সবাই জানি। বিশেষ করে যাদের দাঁত নেই তারা ভাল বুঝবে। এই দাঁতকে যারা সুস্থ রাখে তারা হল সেই মহান ডেন্টিস্ট বা দন্ত চিকিৎসক নামে পরিচিত। ডেন্টিস্ট বা দন্ত চিকিৎসক সারাবিশ্বে অত্যান্ত সম্মান যোগ্য পেশা। আর দাঁত মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মুখে অবস্থিত একটি অঙ্গ। এটি খাদ্য চর্বণ ও কর্তনের (কাটা) কাজে ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ প্রাণীর দেহে দাঁতই হচ্ছে কঠিনতম অঙ্গ। এই দাঁত বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন: (ক) মোলার বা সাদা বাংলায় “কষ দাঁত”: এটি খাদ্যকে চিবিয়ে পিষে ফেলার কাজে ব্যবহৃত হয়। (খ) কার্নাসিয়াল দাঁত ব্যবহৃত হয় খাদ্য কর্তনের কাজে। এটি কেবল শ্বাপদ (মাংসাশী) প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়। (গ) প্রি-মোলার দাঁত মোলার দাঁতের মতই, কিন্তু আকারে ছোট, এবং অনেক সময় এদেরকে বাইকাস্পিডও বলা হয়। (ঘ) শ্বদন্ত বা ক্যানাইন খাদ্য ছিঁড়ে ফেলার কাজে ব্যবহৃত হয়। একে কাস্পিড দাঁতও বলা হয়ে থাকে। (ঙ) ছেদক দন্ত বা ইন্সিসর খাদ্য ছেদনের কাজে ব্যবহৃত হয়। এই মূল্যবান দাঁত পরিষ্কার রাখার উদ্দেশ্যই হচ্ছে দাঁতের আবরণে ও ফাঁকা জায়গায় অবস্থানরত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে দূরে রাখা। দন্ত্যচিকিৎসা মুলত মুখগহ্বর সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা করে। অন্যান্য আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠির তুলনায় সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য মুখগহ্বরের রোগগুলোই গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা কারণ হল এর অধিকতর ব্যাপ্তি এবং বিশ্ব জোড়া প্রাদুর্ভাব। দাঁতের বেশিরভাগ চিকিৎসা করা হয় দুইটি অত্যন্ত প্রচলিত মৌখিক রোগের প্রতিরোধ বা প্রতিকারের জন্য এগুলো হল দাঁতের ক্ষয়রোগ আর মাড়ির অসুখ বা পায়েরিয়া। সাধারণ চিকিৎসাগুলো হল দাঁতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, উৎপাটন বা দাঁতের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ, দাঁত স্কেলিং অথবা রুট ক্যানাল। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুসারে দাঁতের যত্নের প্রায় পুরোটাই নিজেদের হাতে। আর যত্ন-আত্তির ব্যাপারটা ঘরের ভেতরই সারতে হয়। দাঁতের যত্নে বিশেষ কোর্স কিংবা স্পেশালিস্টের দ্বারস্থ হতে হয় না। কেবল বাড়িতে বসে নিয়মমাফিক দাঁতের কিছু যত্ন-আত্তি করলেই দাঁত ভালো রাখা যায়। তবে কারও দাঁতে সমস্যা দেখা গেলে ভিন্ন কথা। তখন তো ডাক্তারের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। তবে আমাদের একটু সচেতনতাই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। গবেষণায় মুখের ভিতরে এ যাবৎ ১৭৪৩ প্রকারের রোগ শনাক্ত করা হয়েছে। ক্যান্সার আক্রান্ত ৩৭ শতাংশই হলো ওরাল বা মুখের ক্যান্সার। ১৯ শতকের সূচনাতে আধুনিক দন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়। এরই মধ্যে পৃথিবীর অনেক দেশের রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত সমভাবে দন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের আধুনিক প্রযুক্তি পৌঁছে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সদস্য দেশসমূহ লিকেজ পয়েন্টগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করে সংস্কারের মাধ্যমে দন্ত চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোকে আধুনিক থেকে আধুনিকতম করা হচ্ছে। সাধারণত আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের ধারণা, দাঁত ব্যথা হলে তার একমাত্র চিকিৎসা হলো দাঁত তুলে ফেলা। কিন্তু একটি রোগাক্রান্ত দাঁতকে সুস্থ অবস্থায় দীর্ঘদিন সুস্থ, সবল রাখতে সব ধরনের চিকিৎসা এখন হচ্ছে। যেমন রুট ক্যানেল চিকিৎসা, ক্রাউন ক্যাপ ইত্যাদি। দাঁত ব্যথা হলে দাঁত ফেলে দিতে হবে এমন কথা নেই। এটা চিকিৎসা বিজ্ঞান সমর্থন করে না। কিন্তু আমাদের বদ্ধমূল ধারণা থেকে এটার সৃষ্টি। মূলত দাঁত ব্যথা হলে তা তুলে ফেলার খরচ সামান্য হলেও এর ফলে হৃদযন্ত্রে বা অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গে যে সমস্যা দেখা দিতে পারে, হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি। এ জন্য আমাদের আগে থেকে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর উন্নত দেশে তাদের হার্ট সংক্রান্ত চিকিৎসার খরচ অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে পেরেছেন দন্ত চিকিৎসকদের কাছ থেকে সঠিক সময়ে পরামর্শ নেয়ার কারণে। দেহের প্রতিটি অঙ্গের সুস্থতার জন্য বিশ্বমানের প্রযুক্তির সাহায্যে দাঁত সুরক্ষিত রাখতেই আমরা সবাই সচেষ্ট। একটি অসুস্থ দাঁতকে উন্নত টেকনোলজির মাধ্যমের সুস্থ করতে যে খরচ হয়, তা ওই হৃদযন্ত্রের চিকিৎসার বিপুল খরচের বহুগুণ কম। কয়েক বছর আগেও দাঁতের ব্যথায় আক্রান্ত রোগীদের একটি বড় অংশ দাঁত ফেলে আলগা দাঁত লাগাতে উৎসাহিত ছিল। তার চেয়েও ভয়াবহ বিষয় ছিল ‘ডেন্টাল চিকিৎসক’ বলে অনেকের কোনো ধারণা ছিল না। কত কম চিকিৎসা খরচে কোথায় দাঁত ফেলা যায় ও লাগানো যায় সেটিই ছিল মুখ্য বিষয়। যেখানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ডেন্টাল পেশাকে সর্বোচ্চ সম্মানজনক পেশা হিসাবে গণ্য করা হয়, সেখানে আমাদের দেশের মানুষের এ নেতিবাচক মনোভাব থেকে হয়তো জনপ্রিয় প্রবাদ চালু হয়েছিল, ‘বাঙালি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না’। দেশের দশ হাজারের অধিক অনুমোদিত ডেন্টাল চিকিৎসক বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে বা সরাসরি রোগীদের বোঝাতে সম হচ্ছেন ডেন্টাল চিকিৎসার গুরুত্ব শরীরের যে কোনো অঙ্গের চিকিৎসার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। দ্রুততম সময়ে ও স্বল্পব্যয়ে প্রতিটি মানুষের দাঁতের চিকিৎসা প্রদানে দুই ধরনের দন্ত চিকিৎসক জনশক্তি গড়ে তোলা হয়, বিশেষজ্ঞ বা গ্র্যাজুয়েট দন্ত চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়, ডেন্টাল কলেজ ও মেডিকেল কলেজে। গ্র্যাজুয়েট দন্ত চিকিৎসকরা জটিল দন্ত চিকিৎসার পাশাপাশি দন্ত চিকিৎসার মান উন্নতির লক্ষ্যে গবেষণা, প্রকাশনা ও অধ্যাপনা কাজে নিয়োজিত থাকেন। আর প্রাথমিক দন্ত চিকিৎসকগণ রাতদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দন্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। পরামর্শ দিয়ে থাকেন কীভাবে সুস্থসবল দাঁত নিয়ে জীবনযাপন করা যায় এবং জটিল পরিস্থিতিতে ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছেও রেফার করেন তাঁরা। এ কারণে পৃথিবীর সব দেশেই দন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানের অসম্ভব উন্নতির চিন্তা গৃহীত হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে দক্ষ দন্ত চিকিৎসা ও পরিচর্যা বিষয়ক জনশক্তি। আবিষ্কার করা হয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক দ্রব্য ও চিকিৎসা পদ্ধতি। কিন্তু এতকিছুর পরেও যদি এই মূল্যবান দাঁতকে রায় নিজে সচেতন না হই তাহলে যে কোন মুহুর্তে ঘটতে পারে বড় বিপদ। কেননা শরীরের যে কোনো অঙ্গের মতো দাঁতের যত্নও অত্যন্ত জরুরি। তাই দাঁতকে ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে নিয়মিত যত্ন ছাড়াও ডাক্তারি চেকআপ প্রয়োজন। তাছাড়া দাঁতে ইনফেকশন থাকা অবস্থায় কোনো রোগীর চোখ, কান, মস্তিষ্ক বা হার্টের মতো অঙ্গে অপারেশন করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। পরিশেষে স্টেরিলাইজেশনের বা জীবাণুমুক্ত পরিবেশে দন্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ এসব রোগ এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে সংক্রামিত হতে পারে। অতএব সচেতনতার সাথে মুখ ও দাঁতের রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করে সুস্থ থাকতে হবে। কেননা মানবদেহের অর্ধেকের বেশি রোগের উৎপত্তির কারণ হলো দাঁত ও মুখের যত্নের অবহেলা। তাই দাঁতের সমস্যা হলে সঠিকভাবে এর সমাধান করতে হবে এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। অন্তত বছরে দুইবার হলেও সুস্থতার লক্ষ্যে দন্ত পরীক্ষা ও মুখ গহ্বরের পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো জরুরী। পৃথিবীতে সুন্দর হাঁসি এবং ঝকঝকে উজ্জ্বল দাঁত পছন্দ করেন না এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দায়। তাই সুন্দর হাসির জন্য চাই সুস্থ দাঁত। আর দাঁত সুস্থ রাখতে হলে নিয়মিত দাঁতের যত্ন নেওয়া চাই। যত্ন নিলে দাঁত সুস্থতো থাকবেই শরীর রক্ষা পাবে বড় ধরনের রোগের অশনি সংকেত থেকে। এবাবের বিশ্ব ডেন্টিস্ট দিবসে কামনা হোক জীবনার সুস্থতার তরে ও সুন্দর হাসির জন্য চাই সুস্থ দাঁত।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট,

কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক : বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি (বাপউস)।



ফেইসবুকে আমরা