বাংলাদেশ, , বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

প্রাথমিক শিক্ষকদের ভূমিকা হোক বাবা-মায়েদের মতো : ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০১৯-১১-৩০ ২০:৩৬:০৪  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : শিক্ষা আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার। শিক্ষক হলো তার সুনিপুণ কারিগর। শিক্ষা ছাড়া আলোকিত মানুষ সৃষ্টি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল এ বিষয়ে বলেছেন, শিক্ষকসমাজ হচ্ছেন প্রকৃতই সমাজ ও সভ্যতার বিবেক। তাই তো শিক্ষকদের বলা হয় ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার’ তথা সমাজ নির্মাণের স্থপতি। সমাজের সার্বিক অগ্রগমনের ক্ষেত্রে শিক্ষা ও শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার থেকে বের হয়ে এসে একজন শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তির মধ্য দিয়ে তার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে মা-বাবা যেমন তার প্রথম শিক্ষা, এই পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা হন তার দ্বিতীয় মাতা-পিতা। মানুষ হিসাবে বাঁচতে হলে আমাদের যেসব জিনিস জানতে হয় তার সবই আমরা শিখি মায়ের কাছে, বাবার কাছে। এরপর আমরা স্কুলে ভর্তি হই দুনিয়াবি শিক্ষা নেয়ার জন্য, আমরা সরাসরি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই না বরং ভর্তি হই প্রাইমারি স্কুলে, যেই স্কুল আমাকে আপনাকে শেখায় কীভাবে অ, আ, ক, খ পড়তে হয়, কীভাবে এক আর এক যোগ করলে দুই হয়, যা শিখেই আমরা পরবর্তীতে রচনা করতে পারি সাহিত্য, পাণ্ডিত্য অর্জন করি গণিতে। পরিবেশ পরিচিতি বই পড়ে আমরা জানতে পারি কোন কোন জিনিস নিয়ে আমাদের পরিবেশ গঠিত, কোন কোন জিনিস আমাদের জন্য ভালো, কোন জিনিস আমাদের জন্য মন্দ তা জেনেই পরবর্তীতে আমরা হই পরিবেশবিজ্ঞানী, তার প্রাথমিক জ্ঞান কিন্তু আসে এই প্রাইমারি স্কুল থেকেই, প্রথম পর্যায়ের চার/পাঁচ বছরে পরিবার থেকে সে যা শিখে আসে, বিদ্যালয়ের সঙ্গে তার এক অম্লমধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিদ্যালয়ে একটি শিশু শৈশবের দশটি বছর পার করে দিয়ে যৌবনে পা রাখে। অপরিণত বয়স থেকে পরিণত বয়সের দিকে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যায় একজন পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার পথে। দ্বিতীয় পর্যায় সেই পর্যায়, যখন একটি শিশু জীবনের অভিজ্ঞতার পৃষ্ঠা থেকে জ্ঞান আহরণের সঙ্গে সঙ্গে অথবা তার পরিবর্তে জ্ঞান লাভের জন্য অভিজ্ঞতাচ্যুত হয় এবং তা পাওয়ার জন্য বইপত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাত ধরে সে বইয়ের জগতে প্রবেশ করে। বড় কঠিন এই দ্বিতীয় পর্যায়। একজন শিক্ষার্থীর স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার সময় এটা। সেই জন্য এই পর্বে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরবর্তী কর্মজীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতার ভিত্তি রচিত হয়ে যায় এই পর্বে। মূলত শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না,এমন বাক্য ছোটবেলা থেকেই আমরা বুঝে বা না-বুঝে মুখস্থ করে এসেছি এবং এগুলো অতিশয় সত্যবাণীও বটে। আর এ মেরুদণ্ড যে কারখানায় তৈরি হয় তার নাম প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটি শিশু ভবিষ্যতে কতটুকু ন্যায়-নীতিবান, আদর্শবান, চরিত্রবান হবে কিংবা দেশ, জাতি, সমাজের প্রতি কতটুকু দায়িত্বশীল হবে এটি অনেকাংশেই নির্ভর করে তাঁর প্রাথমিক জীবনের শিক্ষার উপর। প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব তাই অপরিসীম। এই সময়ের প্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে কি করা উচিত, এক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সমাজ এবং শিক্ষকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে সমস্যা এবং তা উত্তরণে কী-ইবা করণীয় সেসব বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার। বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অকান্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার মান আগেকার যেকোনো সময়ের চেয়ে অত্যন্ত ভালো হয়েছে তাতে সন্দেহ নাই। আমরা জানি, এক দশক আগেও বাংলাদেশে স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীর হার ছিল খুব কম এবং মেয়েদের হার ছিল আরও কম। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ যেমন সময়মত বই বিতরণ, বিনাবেতনে শিক্ষা, ফ্রি টিফিনের ব্যবস্থা, বাল্যবিবাহ রোধ প্রভৃতি কারণে স্কুলগামী ছেলেমেয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি শিক্ষার হারও প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। এটা একটা মহৎ ও শুভ লক্ষণ। এর মধ্যে দিয়ে শিক্ষার ভিত মজবুত হচ্ছে। প্রসঙ্গত জাপানিরা সবচেয়ে বেশি বিনয়ী জাতি। তাছাড়া অন্যান্য মৌলিক মানবীয় গুণাবলি যেমন : সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, কাজের প্রতি আন্তরিকতা, পরোপকারিতা, সেবা প্রদানে আন্তরিকতা, দেশপ্রেম এগুলোতো আছেই। জাপানিদের নার্সারি স্কুলে প্রথম ছয় বছর বাচ্চাদেরকে অষঢ়যধনবঃ আর কিছু সংখ্যাগত ধারণা ছাড়া পাঠ্যপুস্তকের তেমন কিছুই পড়ানো হয় না, এমনকি নির্ধারিত সিলেবাস বা কোনো পাঠ্যবই নিয়েও স্কুলে যেতে হয় না। সেখানে শিক্ষকরা বাবা-মায়ের স্নেহমমতা দিয়ে যা শেখান তা হলো আদর্শ নীতি-নৈতিকতা, সততা এবং দায়িত্ববোধ। উদাহারণস্বরূপ, কীভাবে খেতে হয়, খাওয়ার আগে ও পরে কী বলতে হয়, বন্ধুর সাথে শিক্ষকের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয়, রাস্তা পারাপারে কী করণীয়, ফোনে কীভাবে কথা বলতে হয়, মানুষের বিপদে কীভাবে সাহায্য করতে হয়, পশুপাখি, ফুল ও গাছপালার সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয়, বাস, ট্রেনে চলাচলের সময় কীভাবে থাকতে হয়, এসব বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয়ভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। এই বিষয়গুলো বলতে বলতে শিশুদের মন-মগজে এমনভাবে গেঁথে দেয়া হয় যে, বড় হয়ে তারা একদিকে যেমন বিনয়ী হয়, অন্যদিকে তারা হয়ে উঠে নৈতিক গুণাবলীসম্পন্ন আদর্শ মানুষ। এই বিষয়গুলো চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা অনেককিছু শিখতে পারি এবং শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করতে পারি। কারণ যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। তাই কোনো জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকদেরও মর্যাদা দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমান সরকার শিক্ষকদের বেতন ভাতা বৃদ্ধিসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। এটা শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি মজবুতকরণে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তা ছাড়াও ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সৎ মানুষ, শিক্ষিত মানুষ ও জ্ঞানী মানুষের। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ সময়ের দাবি। তাই তো শিক্ষকমণ্ডলী যাঁরা আগামীর জন্য মানুষ সৃষ্টি করেন তাঁদের দায়িত্ব অনেক বেশি। একজন শিক্ষকই পারেন একজন সুন্দর ও জ্ঞানী মানুষ তৈরি করতে। মানুষ যদি জ্ঞানী না হয় এবং জ্ঞানসমৃদ্ধ না হয় তা হলে এই শিক্ষা সমাজের কোনো কাজে আসতে পারে না।
সুতরাং নীতিনৈতিকতাবোধ ও বিবেকসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থার পরিবেশ সৃষ্টিতে সকলের সম্মিলিত প্রয়াস যেমন জরুরী, তেমনি বাবা-মায়ের পরে এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ হতে পারে শিক্ষকদের উপর। এতে করে জীবনের প্রতিটি ধাপে বাবা-মায়েদের পরে শিক্ষকের অবস্থান সুনিশ্চিত। তাই তাঁদেরকে দ্বিতীয় বাবা-মা বললেও ভুল হবে না। আর এই বাবা-মায়েদের ভূমিকায় থাকা শিক্ষকদের খেয়াল রাখতে হবে তাঁরা যেন তাঁদের প্রতিটি সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেন ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে মানুষ করেন এবং চলার দীক্ষা দান করেন। তা হলে আগামীর সোনার বাংলাদেশ আরও সুন্দর ও সুশৃঙ্খল হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি।



ফেইসবুকে আমরা