বাংলাদেশ, , শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

দাঁতের সঠিক চিকিৎসা ও আমাদের করণীয় : ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০২০-০১-১৬ ২১:২২:২৭  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : চিকিৎসক বা ডাক্তার হলেন একধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রদায়ক, যাঁদের পেশা (অর্থাৎ চিকিৎসাবিদ্যা বা ডাক্তারী) হল শারিরীক বা মানসিক রোগ, আঘাত বা বিকারের নিরীক্ষণ, নির্ণয় ও নিরাময়ের দ্বারা মানুষের স্বাস্থ্য বজায় রাখা বা পুনর্বহাল করা। এঁদের মধ্যে কেউ যদি কোন বিশেষ প্রকারের রোগ বা রোগী বা চিকিৎসা পদ্ধতির চর্চার প্রতি নিবিষ্ঠ হন তাদের সেই রোগ বা রোগীর প্রকার বা পদ্ধতির বিশেষজ্ঞ বা স্পেশালিস্ট বলা হয়। অন্যরা যাঁরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক, পরিবারকেন্দ্রিক, জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক ইত্যাদি বিভিন্ন ভিত্তিতে, বয়স রোগ নির্বিশেষে, ক্রমান্বয়ে বা সর্বতোভাবে সাধারণ মানুষের নানারকম রোগবিকারাদির সাধারণ চিকিৎসা করে থাকেন তাদের জেনারেল প্রাক্টিসনার বলা হয়। চিকিৎসার সঠিক ব্যবহার শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানের বুনিয়াদি পঠনভিত্তিক জ্ঞানের উপরেই নির্ভর করে না, আরো নির্ভর করে এই বিজ্ঞানকে পরিশীলিতভাবে প্রয়োগ করবার ফলিত কলাবিদ্যায় পারদর্শীতার উপর। চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যসেবার অন্যান্য পেশাদারী ব্যক্তিদের (যথা: ঔষধশিল্পের সাথে জড়িত ফার্মাসিস্ট, নার্স, দন্তবিশারদ ইত্যাদি) সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। দাঁতও তো শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মতো একটি অংশবিশেষ।

দাঁতের স্বাভাবিক বৃদ্ধির সময়কে কাজে লাগিয়ে এলোমেলো দাঁতগুলো ঠিক করা হয়। মাড়ি ও টিস্যু রোগের চিকিৎসা করা হয়। দাঁতা ভেঙে যাওয়া, মুখের অস্বাভাবিক গঠন, জটিলতা দূর করা, মুখের মধ্যে ও চোয়ালে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি যেমন-টিউমার অপারেশন করা হয়। শিশুদের দাঁতের চিকিৎসাসেবায় বিশেষজ্ঞ রয়েছে। কৃত্রিম দাঁত বসানোয় বিশেষজ্ঞরা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী কৃত্রিম দাঁত সংযোজন করে থাকেন। দাঁতের ভেতরে স্ট্রাকচারের ওপর চিকিৎসা করে থাকেন। নার্ভ ইনফরমেশন চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞরা রুট ক্যানেলের চিকিৎসাও করে থাকেন। মূলত চিকিৎসা জ্ঞানের পাশাপাশি আলাদা কিছু দক্ষতাও অর্জন করতে হয় একজন দাঁতের ডাক্তারকে। এর মধ্যে রয়েছে রোগীর সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা; ধৈর্যের সঙ্গে দাঁত ও মুখের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা; দাঁতের চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রযুক্তির ব্যবহার শেখা; গভীর মনোযোগের সঙ্গে নিখুঁতভাবে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করতে পারা এবং নিজের দক্ষতা বাড়াতে দাঁতের চিকিৎসায় নতুন নতুন পদ্ধতি ও গবেষণা সম্পর্কে খোঁজ রাখা এবং এর চর্চা করা। আর বর্তমানে ডেন্টাল সার্জারি মূল চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্বতন্ত্র শাখা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মুখের ভিতরে এ যাবৎ ১৭৪৩ প্রকারের রোগ শনাক্ত করা হয়েছে। ক্যান্সার আক্রান্ত ৩৭ শতাংশই হলো ওরাল বা মুখের ক্যান্সার। ১৯ শতকের সূচনাতে আধুনিক দন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়। এরই মধ্যে পৃথিবীর অনেক দেশের রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত সমভাবে দন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের আধুনিক প্রযুক্তি পৌঁছে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সদস্য দেশসমূহ লিকেজ পয়েন্টগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করে সংস্কারের মাধ্যমে দন্ত চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোকে আধুনিক থেকে আধুনিকতম করা হচ্ছে। সাধারণত আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের ধারণা, দাঁত ব্যথা হলে তার একমাত্র চিকিৎসা হলো দাঁত তুলে ফেলা। কিন্তু একটি রোগাক্রান্ত দাঁতকে সুস্থ অবস্থায় দীর্ঘদিন সুস্থ, সবল রাখতে সব ধরনের চিকিৎসা এখন হচ্ছে। যেমন রুট ক্যানেল চিকিৎসা, ক্রাউন ক্যাপ ইত্যাদি। মূলত দাঁত ব্যথা হলে তা তুলে ফেলার খরচ সামান্য হলেও এর ফলে হৃদযন্ত্রে বা অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গে যে সমস্যা দেখা দিতে পারে, হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি। এ জন্য আমাদের আগে থেকে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর উন্নত দেশে তাদের হার্ট সংক্রান্ত চিকিৎসার খরচ অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে পেরেছেন দন্ত চিকিৎসকদের কাছ থেকে সঠিক সময়ে পরামর্শ নেয়ার কারণে। দেহের প্রতিটি অঙ্গের সুস্থতার জন্য বিশ্বমানের প্রযুক্তির সাহায্যে দাঁত সুরতি রাখতেই আমরা সবাই সচেষ্ট। একটি অসুস্থ দাঁতকে উন্নত টেকনোলজির মাধ্যমের সুস্থ করতে যে খরচ হয়, তা ওই হৃদযন্ত্রের চিকিৎসার বিপুল খরচের বহুগুণ কম। আমাদের দেশে উন্নত ও আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তির মাধ্যমে এক একটি দাঁতের ক্ষেত্রে এ খরচ প্রায় চার হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। অনেকেই দাঁতের ক্যাভিটি ও মাড়ির যত্ন নিয়েই ভাবেন। তাদের জন্য বলছি ক্যাভিটি ও মাড়ির রোগের চেয়ে মুখ গহ্বরের যত্নও জরুরী। গবেষণায় দেখা গেছে যে কোনও ব্যক্তির মুখের স্বাস্থ্য এবং তাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের মধ্যে একটি মিল রয়েছে। মুখের ভেতরের স্বাস্থ্য সমস্যাকে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের বোঝা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। চিকিৎসা ছাড়া দাঁতের ক্ষয় বা মাড়ির সমস্যা, ব্যথা, দাঁত পড়ে যাওয়া এমনকি আত্মবিশ্বাসের সংকটও তৈরি হতে পারে। এই সমস্যাগুলো অপুষ্টি, কথা বলার সমস্যাসহ আপনার জীবনকে চ্যালেঞ্জের মুখে নিয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের প্রত্যেকটি লোকই জীবনে এক বা একাধিক দাঁতের রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। মানবদেহের অর্ধেকের বেশি রোগের উৎপত্তির কারণ হল দাঁত ও মুখের অযত্ন, অবহেলা। দন্তচিকিৎসার পরিধি আজ শুধু দাঁত তোলা আর দাঁত বাঁধানোতে সীমাবদ্ধ নেই। এর পরিধি এখন অনেক বিস্তৃত। কারণ মুখের অনেক রোগ থেকেই দেহের সাধারণ রোগ হতে পারে। যেমন- হার্ট ডিজিজ বা হৃদরোগীদের দাঁত তুলার আগে সঠিক এন্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ানো ও গর্ভকালীন সতর্কতার সাথে ওষুধ খাওয়ানো এবং শিশুদের সুস্থ দেহের জন্যও দাঁত ও মুখের সুস্থতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তবে এসব ক্ষেত্রে তাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের (যাদের চিকিৎসায় আছেন) সাথে পরামর্শ করেই দাঁতের চিকিৎসা করা ভালো। দাঁতে ইনফেকশন আর ডায়বেটিসের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত। ডায়বেটিস রোগীদের দাঁতের ইনফেকশন হওয়া ঝুঁকি থাকে একজন সুস্থ মানুষের চেয়ে শতকরা সাড়ে তিন ভাগ বেশি। তেমনি এর উল্টোটাও হয়ে থাকে। তাছাড়া ডায়বেটিস রোগীদের দাঁতের সংক্রমণ হলে তাদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। দাঁতে ইনফেকশন বা পেরিওডেন্টাইটিস রোগ যদি জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে তা নিঃসন্দেহে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এ কথা বেশ স্পষ্টভাবেই জানান জার্মানির দন্তবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ক্রিস্টফ ড্যরফার। আর দাঁতে বাসা বাঁধা জীবাণু নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে ফুসফুসেকে আক্রান্ত করতে পারে। তবে এটা সাধারণত হয়ে থাকে যাঁরা বেশি সময় ধরে বিছানায় শুয়ে থাকে, তাদের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে হাসপাতালের বিছানায় বেশিদিন শুয়ে থাকলে এমনটা হতে পারে। এমনিতেই দাঁতের ইনফেকশন বা পেরিওডেন্টাইটিস এবং হৃদরোগ দু’টো একে-অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত। এ বিষয়ে করা বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানান বিশেষজ্ঞ ড্যরফার। এ কারণে পৃথিবীর সব দেশেই দন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানের অসম্ভব উন্নতির চিন্তা গৃহীত হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে দক্ষ দন্ত চিকিৎসা ও পরিচর্যা বিষয়ক জনশক্তি। আবিষ্কার করা হয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক দ্রব্য ও চিকিৎসা পদ্ধতি। দ্রুততম সময়ে ও স্বল্পব্যয়ে প্রতিটি মানুষের দাঁতের চিকিৎসা প্রদানে দুই ধরনের দন্ত চিকিৎসক জনশক্তি গড়ে তোলা হয়, বিশেষজ্ঞ বা গ্র্যাজুয়েট দন্ত চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়, ডেন্টাল কলেজ ও মেডিকেল কলেজে। গ্র্যাজুয়েট দন্ত চিকিৎসকরা জটিল দন্ত চিকিৎসার পাশাপাশি দন্ত চিকিৎসার মান উন্নতির লক্ষে গবেষণা, প্রকাশনা ও অধ্যাপনা কাজে নিয়োজিত থাকেন। আর প্রাথমিক দন্ত চিকিৎসকগণ রাতদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দন্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। পরামর্শ দিয়ে থাকেন কীভাবে সুস্থসবল দাঁত নিয়ে জীবনযাপন করা যায় এবং জটিল পরিস্থিতিতে ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছেও রেফার করেন তাঁরা। প্রাথমিক দন্ত চিকিৎসকদের এই অবদান কখনো খাটো করে দেখার নয়। তার সত্ত্বেও প্রাথমিক দন্ত চিকিৎসকদের নিয়ে নানান সময়ে নানান কথা উঠেছে। তাঁদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখে কুৎসা রটনা করা হয়েছে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে অভিজ্ঞ প্রাথমিক দন্ত চিকিৎসকগণ তাঁদের আন্তরিকতা ও চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। যা একটি মাইলফলক। কালের প্রেক্ষিতে ‘কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে’ দাঁতের ব্যথা নিয়ে কবির এ কবিতাটি অনেকেই উচ্চারণ করেন। আর এই উপলব্ধির আগেই এই বিষয়ে প্রতিকার জরুরী। কেননা শরীরের যে কোনো অঙ্গের মতো দাঁতের যত্নও অত্যন্ত জরুরি। তাই দাঁতকে ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে নিয়মিত যত্ন ছাড়াও ডাক্তারি চেকআপ প্রয়োজন। তাছাড়া দাঁতে ইনফেকশন থাকা অবস্থায় কোনো রোগীর চোখ, কান, মস্তিষ্ক বা হার্টের মতো অঙ্গে অপারেশন করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। পরিশেষে স্টেরিলাইজেশনের বা জীবাণুমুক্ত পরিবেশে দন্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ এসব রোগ এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে সংক্রামিত হতে পারে। অতএব সচেতনতার সাথে মুখ ও দাঁতের রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করুন, সুস্থ থাকুন। সবশেষে, একটি মূল্যবান দাঁত ফেলে দেয়ার আগে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিষ্ট ও সাধারণ সম্পাদক : বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি।



ফেইসবুকে আমরা