বাংলাদেশ, , শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

চুনতিতে শাহ ছাহেব কেবলা সীরাতুন্নবী (সা.) প্রতিষ্ঠা করে সর্ব শ্রেণীর মুসলমানদের জন্য প্রেরণার ঝর্ণাধারা তৈরি করে গেছেন : ডাঃ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০১৯-১১-১৬ ১৬:৪২:০৬  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)। তিনি রহমতুল্লিল আলামীন হিসেবে এসেছিলেন এই পৃথিবীতে। এই রহমতের নবী আল্লাহর পেয়ারা হাবিব নবী করিম (সা.) এর এ ধূলির ধরায় আগমনের সারণি হিসেবে রবিউল আউয়াল মাসে পবিত্র মিলাদুন্নবী বা নবীজন্মদিন উদযাপনের রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। এসব মাহফিল প্রধানত নবী করিম (সা.) এর জন্মকালীন কিছু অলৌকিক ঘটনা, হজরতের মুজেজার বর্ণনা ও দরুদ-সালামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত।কিন্তু চুনতির সিরাতুন্নবী মাহফিলে আলোচ্য বিষয় এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়, ফলে নবীজির সমগ্র জীবনের একটি তথ্যচিত্র, সমাজ ও যুগের চাহিদার আলোকে নবীজীবনের আদর্শ ও ইসলামের পুরো ইতিহাস আলোচনায় এসে যায়। এ মাহফিলের বক্তাদের অন্তত কয়েক মাস আগে থেকে নির্ধারিত বিষয়বস্তুর ওপর পড়াশোনা করে নোট তৈরি করতে হয়। সিরাতুন্নবী মাহফিলের এ ব্যতিক্রম ধারাটি নিশ্চিতভাবেই পবিত্র মিলাদুন্নবী (সা.) বা সিরাতুন্নবী (সা.) উদযাপনের ক্ষেত্রে জাতির সামনে একটি দিকনির্দেশনা। সামগ্রিকভাবে বিচার করলে মাহফিলের আলোচ্য বিষয়গুলোর মূল প্রতিপাদ্য হলো : আল্লাহর রাসুলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর তার পবিত্র জীবন ও সুন্নত অনুসরণের তাগাদা। আমাদের সমাজে একটি শ্রেণি নবীজির ভালোবাসার দাবিতে এমন আত্মহারা হয়ে যান যে, নবীজির আদর্শ অনুসরণের কথা তারা বেমালুম ভুলে যান। আরেকটি শ্রেণি নবীজীবনের আদর্শের দোহাই দেয় বটে, নবীজির প্রতি ভালোবাসার আলাদা অস্তিত্ব তারা স্বীকার করে না। এ ক্ষেত্রে চুনতির সিরাতুন্নবী দেশ ও জাতির জন্য একটি আলোকবর্তিকা। এখানে একদিকে নবীজীবনের আদর্শ অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা এবং তাঁর কর্মপন্থা সমাজের সামনে তুলে ধরা হয়, অপরদিকে আল্লাহর পেয়ারা হাবিবের মহব্বতে জীবনকে রঙিন করার প্রেরণায় উজ্জীবিত করা হয়। এ মাহফিলের সব কাজ আল্লাহর রাসুলের ভালোবাসায় কীভাবে নিবেদিত, তা উপলব্ধির জন্য মাহফিলের প্রতিষ্ঠাতার মজজুব থাকাকালীন সমুচ্চারিত একটি বাক্য বিবেচনা করাই যথেষ্ট হবে। ১৯০৪ সালে চুনতী গ্রামে হযরত মাওলানা শাহ হাফেজ আহমদ (রহ:) (শাহ সাহেব কেবলা চুনতী নামে পরিচিত) জন্মগ্রহণ করেণ। পিতা মাওলানা সৈয়দ আহমদ (রহ:) এবং মাতা হাজেরা খাতুন। তাঁর পূর্ব পূরুষ হযরত শাহ আলম খন্দকার আরব দেশ হতে স্থল পথে দিল্লীতে আসেন। দিল্লী থেকে নৌ পথ চট্টগ্রামের আনোয়ারা আসেন। সেখান থেকে বাঁশখালি উপজেলার কালীপুর গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তার পুত্র ইব্রাহিম খন্দকার চুনতীতে এসে বসতি স্থাপন করেন। বিখ্যাত আলেম ও দরবেশ কাজী মুহাম্মদ ইউসুফ আলী (রহ:) হযরত মাওলানা শাহ হাফেজ আহমদ (রহ:) এর দাদাজান। কাজী ইউসুফ আলী আরকানের অন্যতম জমিদার ছিলেন। হযরত মাওলানা শাহ হাফেজ আহমদ (রহ:) বাঁশখালীর ছনুয়া মাদ্রাসা, চন্দনপুরা দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসা ও কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেন। কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল ডিগ্রী অর্জন করেন। কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে অসুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরেন। তারপর দাদার জমিদারী দেখার জন্য আকিয়াবে (বর্তমান মায়ানমার) চলে যান। সেখানে তিনি মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন পর তিনি ইমামতি ছেড়ে দিয়ে পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এভাবে তিনি ২০/২২ বছর পাহাড়-জঙ্গল, শহর-বন্দর, ঝড়-বৃষ্টিতে আল্লাহর জিকির ও প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) এর প্রশংসা করে বেড়াতেন। মাঝে মাঝে তিনি চুনতীতে আসতেন। তাঁর কেরামতের কথা এখনো লোক মুখে শুনা যায়। আরকান সড়কের গাড়ি চালকদের নিকট প্রথম তাঁর কেরামত প্রকাশ পায়। ওই সময়ে আরকান সড়ক কাঁচা থাকায় চালকদের গাড়ি চালানো কষ্ট হত। চালকদের সাহায্যার্থে শাহ সাহেব কেবলা উপস্থিত হতেন। ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি চুনতীর “হাফেজ মামু” নামে পরিচিতি লাভ করেন। জনশ্রুতি আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর গাড়ি বহর আরাকান সড়কের ঢালায় আটকা পড়ে যায়। এমন সময় পাশের গভীর জঙ্গলে মানুষের উপস্থিতি দেখে মিত্রবাহিনী গুলি চালালেন। কিছুক্ষন পর এক লোক কিছু গুলি হাতে নিয়ে গাড়ির নিকট আসল। তখন মেজর তাঁকে সম্মান করে গাড়িতে তুললেন এবং সিটে বসালেন। লোকটি চালককে গাড়ি চালাতে বললেন। গাড়ি সচল হয়ে গেল। সেই লোকটি হলেন শাহ সাহেব কেবলা। ফলে আরকান সড়কে গাড়ি চালকদের নিকট শাহ সাহেব কেবলা একজন অলি এবং দরবেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এরকম অনেক কেরামতের ঘটনা শাহ সাহেব কেবলার জীবদ্দশায় ঘটেছে। মুসলমানদের ঈমানী চেতনাকে জাগরণ ও রাসূলের (সা.) জীবনের বাস্তব শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দিকে ধাবিত করার মহান উদ্দেশে ১৯৭২ সালে লোহাগাড়া উপজেলার চুনতির মহান আধ্যাত্মিক সাধক আশেকে রাসূল (সা.) হিসেবে খ্যাত হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ প্রকাশ (শাহ সাহেব কেবলা) (রা.) বিশ্বের একমাত্র ১৯ দিনব্যাপী সীরাতুন্নবী (সা.) প্রতিষ্ঠা করে সর্ব শ্রেণীর মুসলমানদের জন্য প্রেরণার ঝর্ণাধারা তৈরি করে গেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রিয় নবীজির সীরাত বর্ণনার এ ঐতিহাসিক মাহফিলটি এখনো জারি রেখেছেন। শাহ সাহেব কেবলা ১৯৭২ সালের ১১ রবিউল আউয়াল ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক চুনতী সিরাতুন্নবী (স:) মাহফিল প্রবর্তন করেন। এই মাহফিল ১৯৭৩ সালে ২দিন, ১৯৭৪ সালে ৩ দিন, ১৯৭৫ সালে ৫ দিন, ১৯৭৬ সালে ১০ দিন, ১৯৭৭ সালে ১২ দিন, ১৯৭৮ সালে ১২ দিন, ১৯৭৯ সালে ১৫ দিন, ১৯৮০ সালে ১৯ দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এরপর থেকে প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে ১৯ দিন ব্যাপী সীরাতুন্নবী (স:) মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দেশ বরেণ্য আলেমরা-বক্তারা ১৯ দিন ব্যাপী মাহফিলে সীরাতুন্নবী (স:)-এ ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক ওয়ায়েজ করেন। ১৯ দিনব্যাপী সিরাতুন্নবী মাহফিলে কখনও মাইকে একটি কথাও বলেননি, কোনো নামাজে ইমামতি করেননি। এমনকি শেষ মোনাজাতও তিনি পরিচালনা করেননি। কাউকে মুরিদ করাননি। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো খলিফাও রেখে যাননি। কোনো কিতাবপত্রও লিখে যাননি। পৈতৃক সম্পদের অতিরিক্ত কোনো সম্পদও রেখে যাননি। ১৯৮৩ সালের ২৯ নভেম্বর মাহফিলের ১৯ দিন আগে শাহ সাহেব কেবলা ইন্তেকাল করেন। চুনতী সীরত ময়দানের পাশে তাঁর মাজার রয়েছে। অসংখ্য ভক্তরা প্রতিনিয়ত তাঁর মাজার জিয়ারতে আসেন। তার ইন্তেকালের পর থেকে এখনো পর্যন্ত এ মাহফিলের কার্যক্রম বিরতিহীনভাবে চলছে।

লেখক: কলামিষ্ট, প্রবান্ধিক ও কেন্দ্রীয় মহাসচিব, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি।



ফেইসবুকে আমরা