বাংলাদেশ, , শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

ঐতিহ্যবাহী শুক্লাম্বর মেলায় পূর্ণার্থীদের ভীড়

  প্রকাশ : ২০২০-০১-১৬ ০০:১৯:৩৭  

পরিস্থিতি ২৪ডটকম/এস. কফিল : চন্দনাইশ উপজেলার বরমা ইউনিয়নের বাইনজুরী গ্রামে সনাতন সম্প্রদায়ের লাখো মানুষের উপস্থিতিতে যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় শেষ হলো ১৫ জানুয়ারি’২০ বুধবার দেশের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক শ্রীশ্রী শুক্লাম্বর দীঘির মেলা ও পূণ্যস্নান। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান শ্রী শ্রী শুক্লাম্বর দীঘি ও তৎসংলগ্ন প্রায় ১০–১২ একর বিশাল এলাকা ও ২ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে এ মেলা বসে। মূলমেলা একদিনের হলেও আগের দিন বিকেল হতে পূণ্যার্থী, তীর্থযাত্রী, দোকানী ও পূজারীদের আগমন ঘটে। সকালে দেখা যায়, মেলাঙ্গনে উপড়েপড়া মানুষের ভীড় জমে। কোথাও তীল ধারনের ঠাঁই ছিল না।

সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান হলেও মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদেরও সমাবেশ ঘটে। তাদেরও সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। বিশেষ করে নারীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয়। মেলায় নাগরদোলাসহ বিভিন্ন ধরনের রাইড প্লাস্টিক, পাইবার, এলুমিনিয়াম, লৌহ, পিতল ও মাটির তৈরি জিনিসপত্র, গ্রামাঞ্চলের তৈরি হস্ত ও কুঠিরশিল্প সামগ্রী, শাকসবজি, মাছ-মাংস, বইপত্র, ধর্মীয় প্রকাশনা, শো-পিচ, স্টেশনারী, কাঠের ফার্নিসার সামগ্রী, ক্রোকারিজ, উলের তৈরি ঝাড়, সাবানজাত দ্রব্য, কসমেটিকস সামগ্রী ইত্যাদির বিকিকিনি চলে।

প্রতি বছরের মত এবারও পৌষ সংক্রান্তির মেলায় পার্শ্ববতী ভারত, নেপাল, ভুটানসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বিভিন্ন মানত নিয়ে এ পীঠমন্দিরে আসেন। মেলায় যারা বিভিন্ন মনোবাসনা নিয়ে আসেন তা পূর্ণ হয় বলে তাদের বিশ্বাস। তাছাড়া সারা বছর প্রতিদিন বিভিন্ন মানস করে  এবং তা পূরণের লক্ষ্যে দীঘিতে দুধ উৎসর্গ, পাঠা বলি ও কবুতর, ফল-ফলাদি ইত্যাদি ভোগ দেন। তাদের মতে দীঘির পানিতে উৎসর্গীত দুধ পানির সঙ্গে না মিশে দীঘিতে তলিয়ে যায়। এ রকম বহু উপাখ্যান আছে এ দীঘিকে ঘিরে।

ভক্তবৃন্দের বিশ্বাস, এখানে দুধ, ছাগল, কবুতর এমনকি সোনার অলংকার উৎসর্গ করলে মনের সব বাসনা পূরণ হয়। এজন্য ভক্ত পূণ্যার্থীরা তাদের মানস পূরণের লক্ষ্যে উত্তরায়ন সংক্রান্তিতে জড়ো হন বলে শুক্লাম্বর দীঘিতে হয়ে উঠে গণমানুষের মিলনমেলা ও পূন্যস্নান। এখানে দিনব্যাপী চলে লক্ষ প্রাণের উৎসব। ভক্তকূল মগ্ন থাকেন পূজা-অর্চনায়। পূর্ণার্থীদের মেলায় এ দিনটি উৎসবমূখর পরিবেশের সৃষ্টি হয় বরমা, বাইনজুরী, সুচিয়া, শেবন্দী, মাইগাতা, চরবরমা, হারলা ইত্যাদি গ্রামে। উপমহাদেশেের হিন্দুদের জন্য অন্যতম তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত শ্রীশ্রী শুক্লাম্বর পীঠমন্দির। শ্রীশ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্য ভারতের নবদ্বীপ থেকে চট্টগ্রামের বরমা বাইনজুরীতে আগমন করেছিলেন। তিনি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে সাধনা শুরু করেন। ওখানেই তিনি সিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর অলৌকিকতায় শঙ্খনদী বরমা এলাকার দিকে প্রবাহিত হতে থাকলে দৈবিক শক্তির মাধ্যমে তিনি নদীর গতি ফিরান বলে সনাতন সম্প্রদায়ে জনশ্রুতি রয়েছে। তৎকালীন সময়ে এলাকায় নারী-পুরুষের বিবাহ অনুষ্ঠানের যাবতীয় সরঞ্জামাদি স্বর্ণ, পৌপ্য, হীরা ও মূল্যবান ধাতুর তালিকা মহাসাধক শুক্লাম্বর এর হাতে দিলে বিবাহের দিন উক্ত দীঘিতে মালামাল ভেসে উঠত বলে ভক্তরা জানান। ঐ সমস্ত মালামাল ব্যবহারের পর সাধকের নিকট ফেরত দিলে, সাধক তা দীঘিতে ফেলে দিতেন। প্রতি বছর এ দিনে শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য দীঘিতে হাজার হাজার হিন্দু নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর দীঘিতে স্নান করেন জীবনের পাপ মোচনের প্রত্যাশায়। মেলায় আগত পূণ্যার্থীরা শুক্লাম্বর দীঘিরপাড়স্থ অশ্বত্থবৃক্ষের ঢালে বিভিন্ন মানস করে সুতার গিট বেঁধে দেন। ঐ অশ্বত্থবৃক্ষে শত শত কবুতর ছেড়ে দেন। তাদের ভাষায় নারী-পুরুষ একসাথে পাপ মোচনের জন্য কোন জড়তা ছাড়া স্নান করা হয়।

জৌলুশপূর্ণ এ মেলায় বিভিন্ন মালামাল কিনতে দেখা যায়। কেউ কেউ গরু বাচ্চা দিলে প্রথম দুধ এ দীঘিতে দিয়ে থাকেন। এমনকি কোন গাছে প্রথম ফল ধরলে এখানে দিয়ে থাকেন। প্রশাসন, দীঘি কমিটি, মেলা কমিটি ও পুরহিতরা পূণ্যার্থীদের সার্বিক সহযোগিতা করেন।

মেলা চলাকালে চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আ ন ম বদরুদ্দোজা, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট প্রবাল চক্রবর্তী, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিবেদিতা চাকমা, থানার অফিসার ইনচার্জ কেশব চক্রবর্তী, চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের ইন্সপেক্টর ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী, মেলা কমিটির সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান মো. নুরুল ইসলাম, দীঘির উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হারাধন দেব, সাবেক সভাপতি মাস্টার বিজন ভট্টাচার্য্য, সাধারণ সম্পাদক নিপেন্দু দত্ত, দক্ষিণ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সেক্রেটারি পরিমল দেব, মেলার সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন দত্ত, অর্থ সম্পাদক আশীষ দেব, প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক পরিমল মহাজন, বরমা প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল, বরমা ইউপি প্যানেল চেয়ারম্যান আবু জাফর, মেম্বার অমর ভট্টাচার্য্য, কমিউনিটি নেতা অরুপ রতন চক্রবর্তী, ডা. কাজল কান্তি বৈদ্য, ডা. বিধান ধর, এডভোকেট রতন সেন, দয়াল দাশ, বিপ্লব চৌধুরী, প্রদীপ দেব, কুইন সাবানের মালিক রুবেল দেব, মেম্বার সোনা দেব,বাদল ধর প্রমুখ সুশৃঙ্খল, সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে মেলা অনুষ্ঠানের জন্য পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক তদারকি করেন।

ঐতিহ্যবাহী মেলাটি সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, চন্দনাইশ থানা, বরমা ইউনিয়ন পরিষদসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন দীঘি ও মেলা কমিটি।



ফেইসবুকে আমরা