বাংলাদেশ, , শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

ইসহাক মিয়া ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বরেণ্য ও জননন্দিত নেতা : সজল কান্তি চৌধুরী

  প্রকাশ : ২০২০-০৭-২৫ ১৬:৩২:৫৮  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : জন্মিলে মরিতে হইবে-চিরন্তন প্রবাদ। কিন্তু নশ্বর এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ অবিনশ্বর হন নিজ কর্মগুণে। তেমনি চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আমাদের এই চট্টগ্রামের কৃতী পুরুষ জননেতা ইসহাক মিয়া এক স্মরণীয় নাম। এ মানবতাবাদী মানুষগুলোই চিরদিন মানুষের মনে স্থান করে নেন। জীবনে ও মরণে এরা আলোকিত। কেউ কেউ পান কিংবদন্তির আসন। মানুষ এদেরকে নিয়ে গবেষণা করে। সমাজের এই মানুষগুলোর চরিত্রের বিভিন্ন গুণাবলী মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যায়। নতুন প্রজন্ম এদের সাফল্যগাথা কীর্তি নিয়ে সাহসে হয় বলীয়ান। এদের কারো কারো জন্ম মৃত্যু পালন করে দেশ ও জাতি। ন্যায় নীতিতে স্বমহিমায় তারা উদ্ভাসিত। তাঁরা আমাদের আলোকবর্তিকা ও বাতিঘর। এদের কর্মযজ্ঞ সমাজ ও জাতিকে আলোর পথ দেখায়। এ ধরনের কীর্তিমানদের একজন জননেতা ইসহাক মিয়া। জীবনে হার না মানা এক ব্যক্তিত্ব। আওয়ামী পরিবারের এক সুপরিচিত মুখ। জীবদ্দশায় তিনি যেমনি স্মরণীয় ও বরণীয়, মৃত্যুর পরও হয়েছেন অবিস্মরণীয়। তিনি ছিলেন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখসমরে দুর্ধর্ষ এক মুক্তিযোদ্ধা।

তিনি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান ছিলেন। চট্টগ্রামবাসীর জন্য তাঁর অকৃত্রিম দরদ, ভালবাসা তাঁকে করেছে মহান। চট্টগ্রামের উত্তর আগ্রাবাদের হাজীপাড়ায় পিতা মরহুম জনাব আলি ও মাতা মরহুমা তমিজা খাতুনের ঘরে ১৯৩২ সালের ১ মে তারিখে জননেতা ইসহাক মিয়া জন্মগ্রহণ করেন। লেখাপড়া শেষ করে ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে যোগদান করে ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার এবং ১৯৬৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে জননেতা এম এ আজিজ ও জননেতা জহুর আহম্মদ চৌধুরীর সাথে ৬ দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে চট্টগ্রাম-৮ নির্বাচনী এলাকায় পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এমপি এ (মেম্বার অব প্রভিন্সিয়াল এসেম্বলী) নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ হলে তিনি বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর ’৭০ সালে নির্বাচিত এম পি এ (মেম্বার অব প্রভিন্সিয়াল এসেম্বলী) এবং এম এন এ (মেম্বার অব ন্যাশনাল এসেম্বলী) উভয়কে নিয়ে বঙ্গবন্ধু এম সি এ (মেম্বার অব কন্সটিটিউয়েন্ট এসেম্বলী) অর্থাৎ গণ পরিষদ গঠন করেন। গণ-পরিষদের সদস্যরাই বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান রচনা করেন। আর জননেতা ইসহাক মিয়া তাঁদেরই একজন। জননেতা ইসহাক মিয়া বঙ্গবন্ধুর খুবই ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। তাঁর সাথে বঙ্গবন্ধুর অনেক স্মৃতি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু যখনই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আসতেন, তখনই ইসহাক মিয়া পাশে থাকতেন। মূলত বঙ্গবন্ধু তাঁকে অত্যধিক স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও ইসহাক মিয়াকে চাচা বলে সম্বোধন করতেন। চট্টগ্রামের কিংবদন্তি নেতা জননেতা এম এ আজিজ ও জহুর আহাম্মদ চৌধুরী ছিলেন ইসহাক মিয়ার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু। ১৯৫৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে মরহুম এম এ আজিজ, এন জি মাহমুদ কামাল ও তারেক আহাম্মদের মাধ্যমে ইসহাক মিয়ার প্রথম সাাৎ হয়। তিনি ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফার পক্ষে জোরালো প্রচার কাজ চালান। ১৯৬৮-৬৯ সালে চলমান গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জয়লাভ, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসাবে দায়িত্ব পালন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ, ১৯৭৯ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ১৯৮৩ সালে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান, ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯০ এর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে বিজয় করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ২০০৭ সালে ১/১১ এর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে অবস্থান নেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার কারামুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৯৪, ২০০০ এবং ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অকান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে নাগরিক কমিটির মনোনীত প্রার্থী জননন্দিত জননেতা আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী এবং আ জ ম নাছির উদ্দীনকে মেয়র নির্বাচিত করে বিজয়ের মালা ছিনিয়ে আনেন। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন রাজনীতিক। রাজনীতিতে পদ ও পদবীর জন্য তিনি কখনো লালায়িত ছিলেন না। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের তিনি দীর্ঘ প্রায় ৪০ বৎসর সহ-সভাপতি ছিলেন। কিন্তু কখনো সভাপতি হবার জন্য তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হননি। জীবনে কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। আজীবন ত্যাগী জননেতা ইসহাক মিয়ার পুরো জীবনটাই ছিল রাজনীতিকে ঘিরে। ২০১৩ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা হিসাবে মনোনীত হন। মৃত্যু অবধি তিনি এ দায়িত্ব ছিলেন। তিনি ছিলেন লোভ লালসার উর্ধ্বে। চট্টগ্রাম বন্দরের মত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক, দুই বার সংসদ সদস্য থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের অর্থনৈতিক সাফল্যের কথা কখনো চিন্তা করেননি। তিনি বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শকে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অনুসরণ করে গেছেন। জননেতা ইসহাক মিয়া নিজেকে কখনো রাজনৈতিক নেতা ভাবেননি বরং রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে দেশ ও জনগণের সেবা করেছেন। নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে ইসহাক মিয়া প্রায়ই বলতেন, ‘সততার রয়েছে হীরার মতো উজ্জ্বল দ্যুতি, সেই উজ্জ্বলতা অন্ধকার দূর করে। তোমরা সৎ চিন্তায় পুষ্ট হয়ে দেশপ্রেমের শক্তিতে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে দেশ গঠনে জীবন উৎসর্গ করে দাও। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমরাই পারবে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে।’ এককথায় মরহুম জননেতা ইসহাক মিয়া ছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতির অভিভাবক। যিনি দলের সর্বস্তরের নেতা কর্মীদের কাছে একজন আদর্শ ও বিশস্ত নেতা ছিলেন। গণ পরিষদ, সংসদ সদস্য, বন্দর চেয়ারম্যান, আগ্রাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাসহ নানা পদপদবীতে থেকেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তেমন কোনো অর্থবিত্তের মালিক হিসেবে বনে যাননি। তাইতো মরহুম জননেতা ইসহাক মিয়া ছিলেন জনমানুষের নেতা, মানুষের কল্যাণে যিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। যার দেশপ্রেম আর মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা আমাদেরকে আজও প্রেরণা যোগায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠকর্মী হিসেবে জননেতা ইসহাক মিয়ার ত্যাগ আওয়ামী লীগে এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর হাতে অর্থসম্পদ এর মালিক হওয়ার অবাধ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সম্পদের প্রতি তাঁর কোনো মোহ ছিল না। অসীম সাহসী ও আদর্শের মূর্ত প্রতিক ইসহাক মিয়া অনুকরণীয় এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। রাজনীতির ক্ষেত্রে যখনই দুঃসময় এসেছে তখন ইসহাক মিয়া বীরের বেশে আওয়ামী লীগের পতাকাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি ভয়কে জয় করেছেন। আমিও এই চট্টগ্রামের একজন সন্তান হিসেবে তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করি। ব্যক্তিগতভাবে আমি সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক হিসেবে তাঁর জীবদ্দশায় বহুবার তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছে। চট্টগ্রামে যখনি কোনো দলীয় সভা-সমাবেশ হয়েছে, সেখানে তাঁর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। আমি দেখেছি, তিনি কীভাবে বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষকে উজ্জীবিত করে রাখতেন। খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে রসালো কথা বলে বক্তব্য দেওয়া ছিল তাঁর একটি বিশেষ গুণ। তিনি রসালো কথাবার্তার মাধ্যমে মানুষকে মোহিত করে তুলতেন। সাধু-চলিত ও মাঝে মাঝে ইংরেজিতেও বক্তব্য রাখতেন। দেশি-বিদেশি অতিথিদের সাথে তিনি চমৎকার করে ইংরেজিতে কথা বলতেন। শেষ জীবনে হার্ট, প্রেসার, ডায়াবেটিস, কিডনির মত জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েও বিরামহীনভাবে জনগণের জন্য তিনি কাজ করেন। চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের প্রিয় জননন্দিত এই নেতা ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই ৮৬ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যু-পরবর্তী ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দান, আগ্রাবাদ সিঙ্গাপুর মার্কেটের সামনে এবং আগ্রাবাদ হাজীপাড়ায় অনুষ্ঠিত তিনটি জানাযায় হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়। জননন্দিত এই নেতা আগ্রাবাদ হাজীপাড়ায় নিজ পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত হন। চট্টগ্রামের দলীয় রাজনীতির অনেক নেতাকর্মীসহ আপামর জনসাধারণকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি পরপারে ঠাঁই লাভ করেন। মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করি, যেন পরপারে ভালো থাকেন আমাদের এই বরেণ্য নেতা। আর স্বর্গসুখে যেন অধিষ্ঠিত হন।

লেখক: কলামিস্ট,নাট্যজন,সাংস্কৃতিক কর্মী।



ফেইসবুকে আমরা